প্রজ্ঞামূলক বিকাশের তত্ত্ব
যেসব তত্ত্ব প্রজ্ঞা কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এবং যেগুলির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উদ্দীপক পরিস্থিতির সামগ্রিকতা ও তার আচরণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে, তাকে বলে প্রজ্ঞামূলক বিকাশের তত্ত্ব।
এই তত্ত্বের প্রবক্তা গেজলার।
পিঁয়াজে এই তত্ত্ব টি কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
পিঁয়াজে প্রজ্ঞামূলক তত্ত্বের চারটি স্তরের কথা বলেছেন সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল----
1) সংবেদন সঞ্চালন মূলক স্তর( জন্ম-2 বছর):-
পিঁয়াজের মতে জ্ঞানমূলক বিকাশের প্রথম স্তরটি সংবেদন সঞ্চালন মূলক স্তর ।এই স্তরের সময়সীমা হল জন্ম থেকে দু বছর পর্যন্ত ।এই বয়সের শিশুরা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন ও ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার করে পরিবেশকে জানতে চাই। যেমন- শিশু তার বুড়ো আঙুল চুষতে থাকে ,তার সামনে কোন খেলনা দিলে সে সেটিকে ধরার চেষ্টা করা ইত্যাদি।
বৈশিষ্ট্য:
আত্মকেন্দ্রিকতা: এই বয়সে শিশুর কেবলমাত্র নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে। অন্যের ভালো-মন্দ বিচার করে না এবং অন্য সবকিছু সে নিজের মনে করে। দুটি শিশু যখন পারস্পারিক কথা বলে তখনও তারা শুধু নিজের চিন্তায় করে।
বস্তুর স্থায়িত্ব: এই স্তরে শিশুদের বস্তুর স্থায়িত্ববোধ থাকে না। চোখের আড়ালে গেলেই বা তাদের কাছ থেকে কোন জিনিস দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেই তারা মনে করে বস্তুটি আর নেই।
শিক্ষাগত তাৎপর্য:
শিশুদের নিকট বিভিন্ন আকার ,আকৃতি ও খেলনার বস্তু দিতে হবে, যাতে বস্তুর আকার, বর্ণ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান।
বিভিন্ন রকমের বস্তু যেমন- শক্ত ,নরম ত্রিভুজ ,চতুর্ভুজ, বৃত্ত, স্থবির, গতিশীল বস্তুর ধারণা জন্মাবে।
দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের সুযোগ ঘটে সেই ধরনের খেলনা শিশুর সামনে দিতে হবে।
2) প্রাক্ সক্রিয়তার স্তর(2-7 বছর):-
দুই থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত বিকাশের স্তর কে পিঁয়াজের জ্ঞানমূলক বিকাশের প্রাক্ সক্রিয়তার স্তর বলেছেন। এই স্তরে শিশুরা কোন কিছুকে সাংকেতিকভাবে প্রকাশ করতে পারে। যেমন- ভাষার ব্যবহার ।কোন কিছু সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে না।
বৈশিষ্ট্য:
বাস্তববাদ: নিজের কল্পনা বা চিন্তার জগতের বাইরে একটা জগত আছে, এই বোধ সৃষ্টি হওয়ার নামই বাস্তববাদ। প্রথমে শিশু বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ সম্পর্কে তার সংশয় থাকে ,পরে এই সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান হয়।
সর্বপ্রাণবাদ: প্রথম প্রথম শিশু জীব ও জড় বস্তুর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না ।অনেক জড়বস্তু কেউ সজীব বলে মেনে নেয়। পিঁয়াজে সর্বপ্রাণবাদের চারটি স্তরের উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল
a) প্রায় সব বস্তুই সজীব এবং সচেতন।
b) কেবল চলনক্ষম বস্তু সজীব।
c) যেসব বস্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলনক্ষম তারাই সজীব।
d) সচেতনতা কেবল জীবজগতে সীমাবদ্ধ।
কৃত্রিমতা: সবকিছুই মানুষ তৈরি করেছে এই বোধ থেকে বাস্তব কে বিচার করার প্রবণতা কে কৃত্রিমতাবোধ বলা হয়। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে পিঁয়াজে বলেছেন, তাঁর পরীক্ষিত অনেক শিশুকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ' কেমন করে চাঁদের সৃষ্টি হয়?' অনেকেই উত্তর দিয়েছিল যখন থেকে আমরা বেঁচে আছি'। অর্থাৎ তারা সবকিছুই মানুষের সৃষ্টি মনে করে।
অবযুক্তি পুনর্বিচার: প্রাক্ সক্রিয়তা স্তরে শিশু চিন্তা আরোহী বা অবরোহী যুক্তি দ্বারা বিচার করা হয় না, তার যুক্তি থাকে এক একটি অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এক একরকম । যেমন- সকালবেলা পাখিরা ডাকে তাই আলো ফোটে ইত্যাদি।
শিক্ষাগত তাৎপর্য:
বিলম্বিত অনুকরণ: এই স্তরে শিশুরা পূর্বে দেখা কোন কাজকে অনুকরণ করতে পারে। যেমন -চিড়িয়াখানা দেখা।
রূপক অভিনয়: শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করতে ভালোবাসে।
অংকন: এই স্তরে শিশু তার মানসিক প্রতিরূপ গুলিকে অংকন এর মাধ্যমে প্রকাশ করে। এটির মধ্য দিয়ে তাদের চিন্তা ও চিন্তার মাত্রার পরিচয় পাওয়া যায়।
মানসিক প্রতিকল্প: এই স্তরে শিশুরা মানসিক প্রতিকল্প গঠন করতে পারে, কিন্তু বস্তু বা ঘটনাসমূহ কে পরিবর্তন করতে পারে না।
ভাষা: এই স্তরের শিশুরা চিন্তার বাহন হিসেবে ভাষা কে ব্যবহার করে। যা কিছু ভাবে তা সবই ভাষায় প্রকাশ করতে করতেই ভাবে। এমনকি খেলার সময়েও তারা অনর্গল কথা বলতে থাকে।
3) মূর্ত সক্রিয়তার স্তর(7-11 বছর):-
পিঁয়াজের তৃতীয় স্তরটি হল মূর্ত সক্রিয়তার স্তর। এর সময়সীমা হল 7 থেকে 11 বছর। এই স্তরে শিশুরা বিপরীত চিন্তার ক্ষমতা রাখে। মূর্ত বস্তুর উপর মানসিক সক্রিয় হতে পারে, কিন্তু বিমুর্ত চিন্তা বা ঘটনার উপর পারেনা।
বৈশিষ্ট্য:
সংরক্ষণ: আকারগত পরিবর্তন হলেও পরিমাণগত পরিবর্তন না হওয়ার বোধই হল সংরক্ষণ। যেমন -এক তাল মাটি নিয়ে তারা আকারের নানা পরিবর্তন করলেও মাটির পরিমাণ কোন পরিবর্তন হয় না।
ক্রমপর্যায়: এই স্তরের শিশুরা বিভিন্ন আকৃতির বস্তু নিয়ে সেগুলিকে ছোট থেকে বড় বা বড় থেকে ছোট আকারে সাজাতে পারে।
শ্রেণীবিভাজন: অধিক সংখ্যক বস্তুর মধ্যে কোনো বিষয়ের প্রেক্ষিতে একত্রীকরণ করাকে শ্রেণীকরণ বলে। পিঁয়াজে প্রাক্ সক্রিয়তা ও মূর্ত সক্রিয়তার স্তরের শিশুদের কুড়িটি ফুল দেখালেন- যাদের মধ্যে 16 টি গাঁদা ফুল এবং 4 টি জবা ফুল। শিশুদের জিজ্ঞাসা করা হয় গাঁদা ফুল বেশি আছে না ফুল বেশি আছে। মূর্ত স্তরে শিশুরা সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল অর্থাৎ ফুলের সংখ্যা বেশি আছে।
সংখ্যার ধারণা: সংখ্যার বোধ এবং গণন ক্ষমতা একই নয়। সংখ্যার বোধ মানে এক,দুই,তিন ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ধারণা।
শিক্ষাগত তাৎপর্য:
এই স্তরের বালকেরা মূর্ত পরিবেশের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে, বিমুর্ত চিন্তায় তারা অক্ষম।
মূর্ত উপযুক্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। যেমন -শ্রেণীকক্ষের সাধারণ উপকরণ( পেন, পেন্সিল ,খাতা ,রবার ইত্যাদি) সংগ্রহ করে তাদের শ্রেণীকরণ করতে বলা।
4) যৌক্তিক সক্রিয়তার স্তর(12-18 বছর বা তার উর্ধে):-
পিঁয়াজের জ্ঞানমূলক বিকাশের চতুর্থ স্তরটি যৌক্তিক সক্রিয়তার স্তর। 12 বছর বয়স থেকে সমগ্র কৌশোর কাল ধরে চলতে থাকে এই স্তরের বিকাশ। এই বয়সে বালকেরা পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির মত চিন্তা করতে থাকে। তাদের যুক্তিগুলি মূর্ত সক্রিয়তা ছেড়ে বিমুর্ত চিন্তনে প্রবেশ করে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করে।
বৈশিষ্ট্য:
এই স্তরের বালকেরা যথার্থ কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করতে সক্ষম হয়।
এই স্তরের বালকেরা সমস্যা সমাধানের জন্য সকল উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তথ্যের সমন্বয় করে সমস্যা সমাধান করে।
কোন ঘটনার অনুবন্ধন ঘটাতে পারে।
অবাস্তব কে মেনে নিয়ে যুক্তিপূর্ণ বিচার করতে পারে।
বিমুর্ত ধরনের চিন্তা করার ক্ষমতা গড়ে ওঠে।
শিক্ষাগত তাৎপর্য:
শিক্ষার্থীরা নিজের বোধ ও সক্রিয়তা নিয়ে খুশি থাকে।
শিক্ষার্থীর কাজ চ্যালেঞ্জিং হবে, কিন্তু এমন কঠিন হবে না যাতে তারা ব্যর্থ হয়ে হতাশ হয়ে পড়ে।
শিক্ষার্থীদের কোন কাজের দায়িত্ব অর্পণ করার পূর্বে যতসম্ভব মূর্ত উদাহরণের সাহায্যে সচেতন করে তুলতে হবে।