মাতৃভাষা চর্চার উপকারিতা বা উপযোগিতা
মাতৃভাষা আমাদের জীবনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারি, জ্ঞান অর্জন করতে পারি, সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারি এবং আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে পারি।
ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি:
- নিয়মিত মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের শ্রবণ, বলা, পড়া এবং লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারি।
- সঠিক উচ্চারণ, ব্যাকরণ এবং বাক্য গঠন শেখা এবং ব্যবহার করা আমাদের ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ করা এবং সাবলীলভাবে ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে সম্ভব।
জ্ঞান অর্জন:
- মাতৃভাষায় জ্ঞান অর্জন করা সহজ এবং দ্রুত।
- মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক, গবেষণাপত্র এবং অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপকরণ তৈরি করা জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
- মাতৃভাষায় শিক্ষাদান জ্ঞানের প্রসার এবং শিক্ষার মান উন্নতিতে সাহায্য করে।
সৃজনশীলতা প্রকাশ:
- মাতৃভাষায় আমরা সাবলীলভাবে নিজেদের ভাব প্রকাশ করতে পারি।
- সাহিত্য, কবিতা, গান, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে সৃজনশীলতা প্রকাশ করা সম্ভব হয়।
- মাতৃভাষায় সাহিত্য ও শিল্পকলার বিকাশ আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা:
- মাতৃভাষা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
- গান, কবিতা, লোককাহিনী, প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদির মাধ্যমে সংস্কৃতি টিকে থাকে।
- মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে পারি।
আত্মপরিচয় ও ঐক্য:
- মাতৃভাষা আমাদের আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি আমাদের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক।
- মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের ঐক্য ও সংহতি আরও দৃঢ় করতে পারি।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি:
- জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান মাতৃভাষায় সহজে আয়ত্ত করা সম্ভব।
- মাতৃভাষায় গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ সম্ভব।
- মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান প্রসারিত করার মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারি।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ:
- মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি:
অন্য ভাষা শেখা সহজ করে:
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নতি:
সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে:
বৈচিত্র্য বজায় রাখা:
আন্তঃজাতিগত বোঝাপত্তি বৃদ্ধি:
উপরে উল্লিখিত উপকারিতাগুলি ছাড়াও, মাতৃভাষা চর্চা ব্যক্তিগত ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, সৃজনশীল চিন্তাধারা বিকাশ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ে সহায়তা করে। সুতরাং, নিজের মাতৃভাষা চর্চা এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা ধরে রাখা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব।
মাতৃভাষা চর্চার উপকারিতা বা উপযোগিতাগুলি আলোচনা করো
ভূমিকা:- ‘ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। মাতৃদুগ্ধ যেমন জীবনের স্বাভাবিক বিকাশকে গড়ে তোলে তেমনি মাতৃভাষার মাধ্যমে মানবিক সত্তার স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে। মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষের সুখ- দুঃখের, হাসি- কান্নার, দুঃখ- বেদনার অনুভূতি প্রকাশ পায়। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষার উপযোগিতা অনস্বীকার্য। মাতৃভাষার উপযোগিতা সামাজিক, ব্যক্তিগত ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভৃতি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য। যেমন:-
(১) সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মাতৃভাষার উপযোগিতা:- বিদ্যালয়ে মাতৃভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে নিম্নোক্ত সামাজিক প্রয়োজনগুলি সিদ্ধ হয়।
(ক) জাতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিতি:- মাতৃভাষায় রচিত কাব্য, নাটক, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, জীবনী পাঠের মধ্য দিয়ে জাতির প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। জাতীয় ঐতিহ্যের মূল স্রোতের সঙ্গে পরিচিত হলে মানুষ আপন সমাজ ও জাতি সম্পর্কে সচেতন হয়।
(খ) বংশগত ঐতিহ্য:- আপন পূর্বপুরুষদের লেখা বা তাদের কীর্তি আমাদের বংশ গৌরবকে যেমন বাড়িয়ে দেয় তেমনি পূর্বপুরুষদের কীর্তি উত্তর পুরুষকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই বংশগত ঐতিহ্য জানার বা উপলব্ধির প্রয়োজনে মাতৃভাষার উপযোগিতা অনস্বীকার্য।
(গ) সামাজিক গুণাবলীর সুষম বিকাশ:- মাতৃভাষা ও সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে দয়া, সহিষ্ণুতা, বন্ধু প্রীতি, সহানুভূতি প্রভৃতি সামাজিক সদগুনের বিকাশ ঘটে।
(ঘ) সুনাগরিকতার শিক্ষা:- সুস্থ চিন্তা ধারণা, সাবলীল প্রকাশভঙ্গি, প্রগাঢ় অনুভূতি, কর্মের সততা, দেশের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শন, ছোটদের প্রতি ভালোবাসা, কথাবার্তা, চালচলন প্রভৃতি গুণ প্রতিটি মানুষকে সুনাগরিক করে গড়ে তোলে। মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে এই সব গুণের প্রকৃষ্ট বিকাশ সম্ভব।
(ঙ) জাতীয় চেতনা ও ভাবগত সংহতি রক্ষার শিক্ষা:- বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, বিভিন্ন প্রকার সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস, মানব প্রীতি, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ, শান্তিমৈত্রী ও প্রগতির আদর্শে ছাত্রসমাজকে উদ্বোধিত করতে হবে। আধ্যাত্মিক ভাবনায় যে ভারতীয় সাধনার মূল সুর তা ছাত্রদের ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা দিতে হবে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মহাপুরুষদের জীবনী, বাণী পাঠ, মহাপুরুষের জন্ম জয়ন্তী পালন ইত্যাদি সম্পর্কে ছাত্রদের অবহিত করতে হবে।
(চ) প্রগতিশীল চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচয়:- মাতৃভাষার মাধ্যমে ছাত্ররা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা উন্নততর চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। দৈনন্দিন জীবনের নতুন খবর, নতুন আবিষ্কার, নতুন চিন্তাধারা সবই অনুবাদ প্রভৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে সঞ্চারিত হয়, ছাত্ররা মাতৃভাষায় অনূদিত বই থেকে সেগুলি সংগ্রহ করতে পারবে।
(২) ব্যক্তিগত দিক দিয়ে মাতৃভাষা চর্চার উপযোগিতা:- ছাত্রদের আত্মপ্রকাশ এর ক্ষেত্রে মাতৃভাষার উপযোগিতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত দিক দিয়ে মাতৃভাষা চর্চার উপযোগিতা গুলি নিম্নে আলোচনা করা হল -
(ক) অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বিকাশ:- ছাত্রদের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা আছে, যেমন সাহিত্য সৃষ্টি, চিত্রাতন শিল্পকর্ম, ভাষাগত দক্ষতা এগুলির বিকাশ মাতৃভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে হতে পারে।
(খ) শিশুদের ক্রমবিকাশের বিশেষ সহায়ক:- মাতৃভাষার মাধ্যমে ছাত্ররা সহজ সরল ভাবে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে এবং শিক্ষকদের বক্তব্য গ্রহণ করতে পারে। এর মাধ্যমে ছাত্রদের চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি, বোধশক্তি, বিচার শক্তির ক্রমবিকাশ ঘটে, তাই মাতৃভাষাকে বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে।
(গ) চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তির মাধ্যম:- মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করলে আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা, সৃজনশীলতার আকাঙ্ক্ষা, আত্মপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি যথাযথভাবে পূরণ হয়। তাই মাতৃভাষা চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তির মাধ্যম।
(ঘ) ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনের সহায়ক:- মাতৃভাষার মাধ্যমে ছাত্ররা কাব্য, সাহিত্য, গল্প প্রভৃতির মাধ্যমে মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। যা ছাত্রদের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনের সহায়ক।
(ঙ) মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য বিষয়ের শিক্ষা:- ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান প্রভৃতি লেখার সময় যাতে তারা সঠিকভাবে মাতৃভাষা ব্যবহার করে সেদিকে শিক্ষকদের বিশেষ নজর দিতে হবে।
(চ) হাসি- কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রীতি ভালবাসার ভাষা:- মাতৃভাষার সাহায্যে ছাত্ররা সুখ-দুঃখ, আনন্দ- বেদনা, হাসি- কান্না ইত্যাদি প্রকাশ করে থাকে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় এই সমস্ত অনুভূতি প্রকাশ করা একেবারেই অসম্ভব।
(৩) জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি:- জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টিতে মাতৃভাষার অবদান অনস্বীকার্য। জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীর ঐতিহ্য, জাতির চিন্তাধারা ইত্যাদি জাতীয় সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। আর জাতীয় সমগ্র রূপরেখা মাতৃভাষার সাহায্য ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টিতে মাতৃভাষার চর্চা একান্ত জরুরী।